তাকওয়া : মুমিন জীবনের অনুপম বৈশিষ্ট্য

Daily Inqilab ফয়জুল্লাহ রিয়াদ

২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

মুমিনজীবনের অন্যতম অপরিহার্য গুণের নাম তাকওয়া। আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানিত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এটাকে জীবন সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় হিসাবে অবিহিত করেছেন। রাসুলও (সা.) একে সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক বানিয়েছেন। যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের বলা হয় মুত্তাকি। পবিত্র কুরআন মুত্তাকিদের জন্য বিভিন্ন সফলতা ও পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে।
তাকওয়া অর্থ : তাকওয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো খোদাভীতি, ধার্মিকতা, হারাম থেকে বেঁচে থাকা, সতর্কতা অবলম্বন করা প্রভৃতি। তাকওয়া মানে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা। সবসময় তাঁর বিধিনিষেধের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। হজরত নুমান ইবনে বাশির (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল সুস্পষ্ট, হারামও সুস্পষ্ট। এ দুইয়ের মধ্যবর্তী বস্তু হলো সন্দেহপূর্ণ। (তা হালাল হতে পারে, আবার হারামও হতে পারে।) অধিকাংশ মানুষ এ সম্পর্কে বেখবর। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহপূর্ণ বস্তু থেকে বেঁচে থাকবে, সে স্বীয় দ্বীন ও সম্মান নিয়ে নিরাপদে থাকবে। আর যে সন্দেহপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়বে, একসময় সে হারামে লিপ্ত হয়ে যাবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৫৯৯) এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, সন্দেহপূর্ণ বস্তু থেকে বেঁচে থাকার নামও তাকওয়া।
তাকওয়ার অনুপম দৃষ্টান্ত : ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) একদিন কাতিবে রাসুল (রাসুলের পত্রলেখক) উবাই ইবনে কা’ব (রা.) কে ‘তাকওয়া’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত কণ্টকাকীর্ণ পথে চলেছেন? ওমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে? ওমর (রা.) বললেন, খুব সতর্কাবস্থায় এমনভাবে, গায়ে কিংবা পোশাকে যেন কাঁটার আঁচড় না লাগে। উবাই ইবনে কা’ব (রা.) বললেন, এটার নামই তাকওয়া। (তাফসিরে ইবনে কাসির) সুতরাং পৃথিবীর পাপ-পঙ্কিলতার পরিবেশে, দ্বীন-ধর্মহীন মূর্খতায় নিমজ্জিত সমাজে বসবাস করেও গায়ে যেন কোনো পাপের আঁচড় না লাগে, এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার নামই তাকওয়া।
কুরআনের আলোকে তাকওয়া : তাকওয়া এমন মূল্যবান বস্তু, যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা মানবসম্প্রদায়কে অসিয়ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে, তার সবই আল্লাহর। আমি তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবের অধিকারীদের এবং তোমাদের জোর নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত ১৩১)। মুত্তাকিরা পার্থিব জগতে প্রশান্তির জীবন অতিবাহিত করেন। কেননা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাদের সঙ্গে থাকেন। সবধরনের বিপদাপদ থেকে তিনি তাদের রক্ষা করেন। বলা হয়েছে, ‘জেনে রাখো, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৪) ইহকাল ও পরকালে তাদের কোনো ভয় চিন্তা ও পেরেশানি নেই। তারা আল্লাহর বন্ধু। ঘোষিত হয়েছে, ‘জেনে রাখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো চিন্তা ও পেরেশানি নেই। তারা সেসব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। ইহজগত ও পরজগতে রয়েছে তাদের জন্য সুসংবাদ’ (সুরা ইউনুস, আয়াত ৬২-৬৪) আল্লাহ তাআলা তাদের পছন্দ করেন। তারাও আল্লাহকে ভালোবাসেন। তাদের জন্য তিনি অপরিসীম রিজিকের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, ‘যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সঙ্কট থেকে নিষ্কৃতির ব্যবস্থা করে দিবেন। এবং তাকে ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দিবেন।’ (সুরা তালাক, আয়াত ২-৩)।
হাদিসের আলোকে তাকওয়া : রাসুল (সা.) তাকওয়া লাভের জন্য দোয়া করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘মহানবি (সা.) এই দোয়া করতেন, হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে হেদায়েত, তাকওয়া, চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও সচ্ছলতা চাই।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৬৭৯৭)। বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করো, রমজানে রোজা রাখো, সম্পদের জাকাত আদায় করো, আমিরের আনুগত্য করো, তবেই তোমরা স্বীয় রবের তৈরি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস ৬১৬) অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘লোকদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত কে? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় মুত্তাকি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ৩৪৯০)।
সাহাবায়ে কেরামের জীবনে তাকওয়া : তাকওয়া মানে খোদাভীতি। আল্লাহর ভয়ে হারাম থেকে বেঁচে থাকা। সাহাবায়ে কেরাম ও সালফে সালেহিনের জীবনীতে এর বিভিন্ন ঘটনা পাওয়া যায়। এক. হজরত আবু বকর (রা.) একদিন কোথাও যাচ্ছেন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর দৃষ্টি পড়ে গাছের ডালে বসে থাকা একটা পাখির দিকে। এতে তিনি হাঁটু গেড়ে বসে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘হায়! আমি যদি এমন পাখি হতাম, যে গাছে গাছে উড়ে বেড়ায়, ফলফলাদি ভক্ষণ করে, পরকালে যার কোনো হিসাবের ভয় নেই।’ দুই. হজরত উসমান ইবনে আফ্ফান (রা.) একদা কবরস্থানে গিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেন। চোখের অশ্রু তাঁর দাড়ি ভিজে গড়িয়ে পড়ছিল। এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘কবর হলো পরজগতের প্রথম ঘাঁটি। কেউ যদি কবরের শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে যায়, পরবর্তী ঘাঁটিগুলো তার জন্য হবে আরো সহজ। যদি কেউ এখানে আটকে যায়, পরবর্তী ঘাঁটিগুলো তার জন্য হবে কঠিনতর।’
তিন. ন্যায়বিচারের জন্য বিখ্যাত খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ একদিন খলিফা সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিকের সঙ্গে হাঁটছেন। তখনো তিনি খলিফা হননি। ছিলেন এক এলাকার গভর্নর। আচমকা বজ্রপাত ও বৃষ্টি শুরু হলে তিনি সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিককে জিজ্ঞেস করেন, ভয় পাচ্ছেন? সুলাইমান বললেন, হ্যাঁ। ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তখন বললেন, তাহলে কিয়ামত দিবসের অবস্থা কেমন হবে ভেবে দেখুন! সাহাবায়ে কেরাম ও সালফে সালেহিনের জীবনীতে এমন অগণিত ঘটনা পাওয়া যায়, যা তাঁদের খোদাভীতির প্রোজ্জ্বল উদাহরণ।
তাকওয়ার অনিবার্য ফলাফল : এর সবচেয়ে বড় ফলাফল হলো সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে সুন্দর একটা রাষ্ট্র উপহার পাওয়া। কেননা যখন কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, সে মিথ্যা বলবে না। কারো হক নষ্ট করবে না। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করবে না। বাজারে সিন্ডিকেট, দালালি করবে না। সুদ-ঘুষ খাবে না। জিনা, ব্যভিচার, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী, চোরাচালান, নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়া ও বেঁচা-বিক্রি সহ সকল অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে ব্যক্তি নিজেকে ও চারপাশকে নিরাপদ রাখবে।


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শীতকাল আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত
পানির-ভারসাম্যতত্ত্ব, আসলনকল নির্ধারণী যন্ত্রের আবিষ্কারক মুসলিম মনীষী
রাসূল (সা.) এর জীবন-চরিত ও ইসলাম
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর : ইসলামের দৃষ্টিকোণ
পিতা-মাতার হক যেভাবে আদায় করতে হয়
আরও

আরও পড়ুন

৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরায়েল

৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরায়েল

ইইউভুক্ত দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের হুমকি কাতারের

ইইউভুক্ত দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের হুমকি কাতারের

দক্ষিণ কোরিয়ার সৌন্দর্যের পেছনে ছুটে বিপদের ফাঁদে পর্যটকরা

দক্ষিণ কোরিয়ার সৌন্দর্যের পেছনে ছুটে বিপদের ফাঁদে পর্যটকরা

ঢাকার বাতাস আজ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’

ঢাকার বাতাস আজ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’

২৮ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদ

২৮ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদ

হিরো নয় কারিনার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে পারি

হিরো নয় কারিনার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে পারি

রাওয়ার নেতৃত্বে আবদুল হক ও ইরশাদ সাঈদ

রাওয়ার নেতৃত্বে আবদুল হক ও ইরশাদ সাঈদ

স্লোভাক প্রধানমন্ত্রীর মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক

স্লোভাক প্রধানমন্ত্রীর মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক

কুমিল্লায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৩ কিশোর নিহত

কুমিল্লায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৩ কিশোর নিহত

গাজীপুরে কারখানা থেকে দগ্ধ আরও এক লাশ উদ্ধার

গাজীপুরে কারখানা থেকে দগ্ধ আরও এক লাশ উদ্ধার

সিরিয়ার আকাশে নিষিদ্ধ হলো ইরানের বিমান

সিরিয়ার আকাশে নিষিদ্ধ হলো ইরানের বিমান

বিমানে ‘ঘুমিয়ে’ ছিলেন বাইডেন : সেনাদের লাশ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা

বিমানে ‘ঘুমিয়ে’ ছিলেন বাইডেন : সেনাদের লাশ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা

ভারতে পণ আইন নিয়ে বিতর্ক, এক ব্যক্তির আত্মহত্যা ঘিরে আলোড়ন

ভারতে পণ আইন নিয়ে বিতর্ক, এক ব্যক্তির আত্মহত্যা ঘিরে আলোড়ন

ভারত সীমান্তের শূন্যরেখায় পড়ে ছিল বাংলাদেশির গুলিবিদ্ধ লাশ

ভারত সীমান্তের শূন্যরেখায় পড়ে ছিল বাংলাদেশির গুলিবিদ্ধ লাশ

এক্সপ্রেসওয়েতে কভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকার সংঘর্ষে নারী নিহত, আহত ৫

এক্সপ্রেসওয়েতে কভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকার সংঘর্ষে নারী নিহত, আহত ৫

ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত

ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত

চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজনকে হত্যা, আহত ৫

চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজনকে হত্যা, আহত ৫

চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ, দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার

চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ, দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার

গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু

গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু

সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার

সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার